Header Ads

অধরা মায়া
- # প্রহেলিকা_অক্ষ (শেষ রাতের আঁধার )
--------------------------
- হ্যালো, মিস প্রহেলিকা বলছেন?
- মিস প্রহেলিকা নয়। মিসেস প্রহেলিকা আর আমি
মিসেস প্রহেলিকার হাসবেন্ড বলছি। কে বলছেন?
- জ্বি স্যার, মিসেস প্রহেলিকার একটা পার্সেল
এসেছে আমাদের কুরিয়ার অফিসে। আপনি কি নিয়ে
যাবেন এসে নাকি আমরা বাসায় পাঠিয়ে দিব?
- কোথা থেকে এসেছে?
- এখানে প্রেরকের শুধু একটা মোবাইল নাম্বার
দেয়া আছে। নাম দেয়া নেই। পাঠানো হয়েছে
গোপালগঞ্জ থেকে।
- আচ্ছা আপনি বাসার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিন।

টেলিফোন নামিয়ে চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইল
অক্ষ। কী যেন ভাবল। অফিসের রুমটায় এসি চলছে।
তবুও কেন যেন কপাল একটু একটু টেলিফোনটা
তুলে বাসায় ফোন দিল অক্ষ।
তিন চার বার ফোন বাজার পর ফোনটা তুলল বাসার
কাজের মেয়েটা।
- তোর আপা কই?
- আপা তো গোসল করে।
- আচ্ছা বের হলে আমাকে কল দিতে বলিস।
- আচ্ছা।

অক্ষের চিন্তাটা কমছে না। স্বাভাবিক একটা ব্যাপার তবুও
চিন্তা হচ্ছে। খানিক পরে প্রহেলি কল করে, ফোন
দিয়েছিলে?
- হ্যাঁ।
- বল।
- কুরিয়ার অফিস থেকে ফোন এসেছিল। তোমার
নামে কে যেন একটা পার্সেল পাঠিয়েছে।
- কে?
- জানি না। আবার তোমার নাম লিখেছে মিস প্রহেলিকা।
- ওওও।
- তুমি কথাটা হালকা ভাবে নিচ্ছ? কী পাঠিয়েছে তা
নিয়ে চিন্তা হচ্ছে না?
- ও মা, আমি না দেখে বুঝব কী করে কী
পাঠানো হয়েছে? আর চিন্তার কী আছে? তুমি
বাসায় ফিরবে কখন?
- জানি না কখন ফিরব। তুমি কী জানতে তোমাকে
কেউ পাঠাবে কিছু?
- আমি জানব কী করে?
- তুমি তাহলে ব্যাপারটা এতো স্বাভাবিক ভাবে নিচ্ছ
কেন?
- আরে, অস্বাভাবিক কিছু তো আমি দেখছি না। আচ্ছা,
আসুক আগে জিনিসটা তারপর বোঝা যাবে।

অক্ষ ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফোনটা রেখে
দিল।
টেবিলের উপর থাকা পেপার ওয়েটারটা বার কয়েক
ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে।
প্রহেলির সাথে বিয়ে হয়েছে চার বছরের মত।
ভালবাসার বিয়ে। ভার্সিটিতে এক বছরের জুনিয়র ছিল
প্রহেলি।
প্রথম দেখার সময়টায় মেয়েটাকে খুব ভাল লেগে
যায় অক্ষের।
দূর থেকে দেখত, ক্লাস শেষে পিছু পিছু বাস
স্ট্যান্ড পর্যন্ত যেত, ল্যাব শেষে ক্লাসের
সামনে দাঁড়িয়ে থাকত, উঁকিঝুঁকি দিত।
এতো সুন্দরী একটা মেয়ে, না চাইলেও চোখ
আটকে যেত।
বুঝতে পারত মেয়েটার জন্য একটা ভালবাসার জায়গা তৈরি
হয়েছে ভিতরে ভিতরে, ভাবত মেয়েটাকে আমার
চাই।
চাই আমার মেয়েটাকে, যে করেই হোক।

আকাশে মেঘ করেছে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা পরিবেশ। বৃষ্টি
হয়েই বুঝি নেমে পড়বে ঠাণ্ডা পুরোদমে। ছাতা
নিয়ে আসেনি অক্ষ।
নিজের প্রাইভেট কারও নেই। ইচ্ছা করলেই
কয়েক মাসের বেতন আর কিছু লোন নিয়ে কিনে
ফেলতে পারে।
কেনা হয় না। এইটুকু দূর অফিস, গাড়ি কিনে কী হবে?
রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।
রিকশা যা পাওয়া যায়, যাবে না। হুট করেই ঝুম বৃষ্টি শুরু।
হেঁটেই যাবার সিদ্ধান্ত অক্ষ বাসায়।
আকাশে বেশ গর্জন দিচ্ছে মেঘ। বিজলি
চমকাচ্ছে। এমন এক বৃষ্টির দিনেই বিয়ে হয়
প্রহেলির সাথে।
বাসর রাতেই ইচ্ছা করছিল সত্যিটা বলে দেয়, বলা হয়
নি। বলা হয় নি আজও। হয়ত কখনও বলাও হবে না।
বিয়ের পর প্রথম রাতে প্রহেলি জানতে
চেয়েছিল, আমাকে বিয়ে করে কি তুমি সুখী?
- অবশ্যই।
- ভালবাসবে সবসময়।
- বাসব।
প্রহেলি অক্ষের বুকের ভিতর মাথাটা লুকিয়ে বলে
তখন, আমি আর কিছু চাই না।
এ কথাটা ছিল প্রচণ্ড আশ্বাসের, খুব বেশী
বিশ্বাসের। এই বিশ্বাস ভেঙে কথাটা বলতে একদমই
ইচ্ছা করে নি।

অক্ষ কলিং বেল চাপতেই প্রহেলি দৌড়ে এসে দরজা
খুলল।
- একদম ভিজে গেছ।
দরজাটা বন্ধ করতে করতে বলল প্রহেলি। একটা
তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে দিয়ে হাতে তোয়ালে
ধরিয়ে দিয়ে বলল, ড্রেস চেঞ্জ করে গোসল
করে আসো। ক্ষুধা লাগছে। খাবো।
- ঠাণ্ডা লাগছে। গোসল করব না।
- আরে না। বৃষ্টিতে ভিজেছ। গোসল না করলে
আরও ঠাণ্ডা লাগবে।
কথা বাড়ায় না অক্ষ। বাথরুমে চলে যায় পোশাক
পরিবর্তন করে। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে গায়ে যখন
পানি দেয় খুব ঠাণ্ডা একটা অনুভূতি বয়ে যায় শিরা উপশিরা
জুড়ে।
এমন ঠাণ্ডা একটা অনুভূতি হয়েছিল সেদিনও। সেদিন
শরীরে কোন ঠাণ্ডা পানি ছুঁয়ে যায় নি। তবুও।
বন্ধুরা বলে, মেয়েটাকে এতো ভালবাসিস তুই।
ভালবাসার কথা বল।
- আমার এতো সাহস নেই, মাথা খারাপ হইছে?
- মেয়ে তোর জুনিয়র। ভয় পাবার কী আছে?
- মেয়ে তো।
তখনকার সময়ে সবার হাতে ফোন ছিল না। ছিল না
অক্ষেরও। তাই ছোট একটা মেসেজ দিয়ে
ভালবাসার কথা বলে দিবে তাও সম্ভব ছিল না।
সবচেয়ে কাছের বন্ধু মাসুদ বুদ্ধি দেয়, একটা চিঠি
লিখ। চিঠিতে ভালবাসার কথা এমন ভাবে বলবি যেন,
মেয়ে চিঠি পড়েই পাগল হয়ে যায়।
- চিঠি লিখব? সামনা সামনি বলাটাই ভাল না?
- তুই সামনা সামনি বললে সব তালগোল পাকিয়ে
ফেলবি। চিঠিতে গুছিয়ে লিখতে পারবি। তুই যদি না
দিয়ে আসতে পারিস। আমি দিয়ে আসব।
সেদিন রাতের বেলা, সারারাত জেগে একটা চিঠি
লিখে অক্ষ। চিঠি লেখবার সময়টায় বার বার মেয়েটার
ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠে।
গভীর মমতা নিয়ে চিঠি লেখার পর মনে পড়ে,
আরে মেয়েটার নামই তো জানে না।
কি বলে সম্বোধন করবে? পুরো চিঠিতে তুমি তুমি
লেখা থাকলেও, ছিল না কোথাও নাম। পরদিন মাসুদের
সাথে দেখা হলে বলে, চিঠি লিখেছিস?
- হ্যাঁ।
- দে।
- সমস্যা আছে তো একটা।
- কী সমস্যা?
- আমি তো ঐ মেয়ের নামই জানি না।
- তুই কি গাধা? নামটাও জানিস না। নাম না জেনে ভালবাসার
ব্যাপার গুলো কল্পনা করিস কী করে?
- তুই কী জানিস?
- আমি কি ভালবাসি যে নাম জানব? তুই একটু দাঁড়া আমি নাম
জেনে আসি।
চিঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকে অক্ষ। শীতকাল শেষ
হচ্ছে, গাছে নতুন পাতা গজাচ্ছে। বেশ মিহি একটা
সবুজ ভাব গাছ গুলোও।
মানুষ প্রেমে পড়লে আশেপাশের প্রকৃতি খুব ভাল
লাগে। ভাল লাগে প্রাকৃতিক সব কিছু। ইচ্ছা করে
ভালবাসার মানুষটাকে বলতে, দেখো না, কী সুন্দর।
ফিরে এসে মাসুদ বলে, প্রহেলিকা।
- কীসের প্রহেলিকা ?
- মেয়েটার নাম প্রহেলিকা।
নামটা শুনে কেমন একটা অদ্ভুত ভাল লাগা ছুঁয়ে যায়
অক্ষের মন জুড়ে। "প্রহেলিকা" কি অসাধারণ নাম।

গোসল করে বেরিয়ে অক্ষ দেখে খাবার নিয়ে
বসে আছে প্রহেলি। কাপড় জড়িয়ে শরীরে
অক্ষ এসে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে,
পার্সেলে কী এসেছে বললে না? কে
পাঠিয়েছে?
প্রহেলি প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বলে,
আজ ছোট মাছের চড়চড়ি করেছি। তোমার অনেক
প্রিয়।
- আমি এটা জানতে চাইলাম?
- আরে বাদ দাও না। কে পাঠিয়েছে কী করে
বলব?
- আচ্ছা পাঠিয়েছেটা কী?
প্রহেলি একটু ইতস্তত করে বলল, একটা লাল শাড়ি আর
কতগুলো লাল চুড়ি।
অক্ষ শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে প্রহেলির
দিকে। প্রহেলি বলে, খাও। দেখো তো রান্না
কেমন হয়েছে?
অক্ষ বলে না কিছু। চুপচাপ মুখে পুড়ে নেয় খাবার।
- সত্যি বিশ্বাস কর আমি জানি না, কে পাঠিয়েছে।
- ঠিক আছে।
- তুমি তো রাগ করছ।
- রাগ করছি না।
- দাঁড়াও আমি ওগুলো ফেলে দিয়ে আসি।
- আরে ফেলতে হবে না। কারও উপহার ফেলতে
হয় না। কেউ তোমাকে ভালবেসে কিছু
পাঠিয়েছে, ফেলে দিবে কেন?
- আমার তোমার আগে কারও সাথে সম্পর্ক ছিল না।
- আমি জানি। এখন তুমি আমি ছাড়া কাউকে ভালবাসতে না।
অন্য কেউ যে তোমাকে তাই বাসতে পারবে না
এমন তো কোন কথা নেই।
- বাসলে বাসুক। আমি কী করব? তাই আমার তার উপহার
নিতে হবে?
- প্রহেলি। আমি রাগ করছি না। রাগ করলে তো
আগেই করতাম। যখন প্রতিদিন ফ্ল্যাটের সামনে
তোমার নাম লিখে ফুল দিয়ে যেত কেউ।
বছর খানেক আগে থেকে এই ব্যাপারটা শুরু
হয়েছিল। কেউ একজন প্রতিদিন সকাল বেলা
প্রহেলি আর অক্ষের পাঁচ তলার এই ফ্ল্যাটের
সামনে ফুল রেখে যেত।
আর সেখানে বেশ জঘন্য রকম হাতের লেখায়
লেখা থাকত, "প্রহেলিকা তোমার জন্য।"
কে দিত সে ফুল জানে না প্রহেলি । জানার কথা না
অক্ষের। প্রথম দিকে একটু আধটু অভিমান অভিমান
দেখাতো অক্ষ। এরপর থেকে স্বাভাবিক ছিল।
বরং সকাল বেলা নিজে থেকেই দরজা খুলে ফুল
নিয়ে এসে প্রহেলিকার সামনে নিয়ে গিয়ে বলত,
তোমার ফুল চলে এসেছে।
একই লেখা, প্রহেলি তোমার জন্য। কেউ আর
লিখে পাঠাল না, অক্ষ তোমার জন্য। কী ভাগ্য নিয়ে
আসলাম।
- দেখো বেশী হচ্ছে। ফেলে দিয়ে আসো
তো ফুল। তুমি এতো যত্ন কর, যেন তোমাকেই
ফুল গুলো পাঠিয়েছে।
- আমার বউকে কেউ ভালবেসে কিছু পাঠাচ্ছে।
কী করে ফেলে দিব বল?
ফুল পর্ব শেষ হবার পর এখন কুরিয়ার পর্ব শুরু। এর
আগে চলছিল, মেসেজ পর্ব।
প্রহেলি মোবাইলে প্রতিদিন একটা করে মেসেজ
আসত, কেমন আছে প্রহেলি ।
কেমন যাচ্ছে দিন। তুমি ভাল থেকো প্রহেলিকা।
শেষমেশ ভালবাসি প্রহেলিকা।
অক্ষের কাছে লুকাতে ইচ্ছা করত না কিছু। তাই সরল
মনেই অক্ষকে দেখাতো তা প্রহেলি।
এসব নিয়ে অক্ষ মাঝে মাঝে বলত, প্রহেলি সত্যি
করে বল না প্লিজ, কে কে তোমাকে ভালবাসত?
- আমি জানি না।
মোবাইলে কল দিলেও নাম্বার বন্ধ পাওয়া যেত।
মেসেজ এরপর ফুল এরপর কুরিয়ারে শাড়ি চুড়ি। কবে
না জানি বাসায় এসে পৌঁছায়।
খাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়ে দুজন। প্রহেলি চুলটা
বেঁধে, অক্ষের বুকের উপর একটা হাত রেখে
বলে, আমি সত্যি কিন্তু জানি না, কে পাঠিয়েছে।
- আমি জানি তুমি আমার সাথে মিথ্যা বল না।
প্রহেলি গুটিসুটি মেরে অক্ষের শরীরের সাথে
মিশে কখন ঘুমিয়ে গেল ঠিক নেই।
অক্ষ জেগে আছে। ভাবনা গুলো মাথার ভিতর
ঘুরপাক খাচ্ছে। মাসুদের মুখে সেদিন নাম শুনে
বলে, কাল আবার ভাল করে চিঠি লিখে নিয়ে আসি। কাল
দিব।
- আচ্ছা নিয়ে আয়। খুব ভাল করে লিখবি। যেন চিঠি
পড়ে তোর কাছে আসেই।

সেদিন রাতটায় আবার চিঠি লিখে অক্ষ। সে চিঠির
অনেকটা জুড়ে ছিল, নামটার কথা। প্রহেলিকা। কী
মায়াময় একটা নাম।
চিঠি নিয়ে পরদিন মাসুদের হাতেই দেয়। মাসুদকে
বলে, বন্ধু কাজ হবে তো?
- হবে না মানে? কিছুক্ষণের মধ্যে দেখবি
প্রহেলি তোর সামনে হাজির।
হলও তাই। চিঠি দিয়ে আসার পর, বন্ধুরা সব মিলে আড্ডা
দেয়। আড্ডায় মন বসে না অক্ষের। বুকের ভিতর
ধড়ফড় করে।
কেমন কেমন যেন লাগে। একটু পর পর এদিক
ওদিক দেখে। এই বুঝি প্রহেলি এলো।
- ভাইয়া একটু শুনবেন?
লাফ দিয়ে পিছন ফিরে তাকায় অক্ষ।
- আমাকে বলছেন?
- জ্বি।
- বলেন।
- আপনি তো অক্ষ ভাইয়া, তাই না?
- হ্যাঁ। আপনি?
- আমি আপনার জুনিয়র। আপনি করে বলার দরকার নেই।
আমি প্রহেলিকা। আমাকে তো আপনি দেখা করতে
বললেন। চিঠি লিখে।

কথাটা শুনে, অক্ষের সারা পৃথিবী ঘুরতে থাকে
মনে হয়। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয় অক্ষ এ
পৃথিবীতে নেই, নেই অক্ষের কোন অস্তিত্ব।
শাওয়ারের পানিতে যেমন শরীরে ঠাণ্ডা অনুভূতি
বয়ে গিয়েছিল। তেমন শরীর একদম ঠাণ্ডা হয়ে
যায়। এই মেয়ে নিজেকে প্রহেলিকা বলছে।
কিন্তু এ তো প্রহেলিকা না। একে অক্ষ ভালও বাসে
না। চিঠিও দেয় নি।
পাশ থেকে বন্ধু গুলো বলে, যাও অক্ষ। একটু কথা
বল। মেয়েটা এতো করে বলছে।
তাছাড়া কত সুন্দরী একটা মেয়ে। সুন্দরীদের কথা
ফেলতে নেই।
কথা গুলো শুনে মেয়েটা মাথা নিচু করে থাকে। কথা
গুলো যেন সহ্য হয় না।
চারপাশে একবার অসহায়ের মত তাকিয়ে, অক্ষকে ওর
চিঠিটা দিয়ে বলে, আপনার চিঠি, আমি আসি।
মেয়েটা দৌড়ে চলে যায়। বন্ধুরা যে কথা গুলো
বলেছে জানে অক্ষ ঠিক সে কথা গুলো
মেয়েটাকে প্রচন্ড আঘাত করেছে।
মেয়েটা দেখতে সুন্দরী না। শ্যামা, মুখের গড়নও
যেমন তেমন, চোখেও সমস্যা, হালকা ট্যাড়া রকম।
এই মেয়েকে যে কেউ সুন্দরী বলে ডাকলে,
মেয়েটা নিজে থেকেই ভেবে নিবে এই সুন্দর
বলাটার মাঝে মিথ্যা আছে।
তুমি অসুন্দর, কুৎসিত, এই কথাটা সে কথার আড়ালে
আছে।
একটা ছেলের চিকন হওয়া আর একটা মেয়ের
অসুন্দর হওয়ার মত অভিশাপ কমই আছে পৃথিবীতে।
সমাজ এ দুটো জিনিস কেন যেন মানতে চায় না।
অক্ষ মাসুদের কাছে জানতে চায়, কী হল এটা?
- কী হল বন্ধু?
- এটা কে?
- প্রহেলিকা। যাকে তুই চিঠি লিখেছিস।
- আমি তো একে চিঠি লিখিনি। এই মেয়েকে পছন্দ
করি না।
- এই মেয়েকে না? তাহলে কাকে? তুই বললি
প্রহেলিকে চিঠি দিতে। আমি তো প্রহেলিকেই
দিয়ে আসলাম।
অক্ষ চুপ করে থাকে। খুব রাগ হয়, কিন্তু প্রকাশ
করে না। অক্ষ বুঝতে পারে, পুরোটাই ছিল মাসুদের
ফাজলামি।
অক্ষ যে মেয়েকে পছন্দ করত, তার নাম
প্রহেলিকা ছিল না। অনেক দিন পর পর জানতে পারে,
সে মেয়ের নাম ছিল, ঈশা।
প্রহেলিকার সাথে এরপর মাঝে মাঝেই কথা বলার
চেষ্টা করেছিল লঅক্ষ।
প্রহেলি অক্ষকে দেখলেই দূরে দূরে থাকত।
চেষ্টা করত এড়িয়ে যেতে। একদিন অক্ষ সামনা
সামনি যায় প্রহেলি।
- প্রহেলি, শোন।
প্রহেলি ধীর পায়ে মাথা নিচু করে অক্ষের সামনে
এসে দাঁড়ায়।
- জ্বি বলেন।
- আমাকে দেখে তুমি এড়িয়ে চল কেন?
প্রহেলি চুপ করে থাকে , অক্ষ একটু এদিক ওদিক
তাকায়। প্রহেলির হাতটা ধরে, হাতের ভিতর আবার সেই
চিঠিটা দিয়ে দেয়। কেঁপে উঠে প্রহেলিকা।
- কী এটা?
- চিঠিটা। এটা তোমাকেই লিখেছিলাম।
- আপনি এটা রাখেন। আমি বুঝতে পেরেছি তো,
আমি দেখতে ভাল না, তাই আমাকে নিয়ে আপনারা মজা
করেন। সেদিনও করেছেন।
- না না, আমার বন্ধুগুলো অমনই। আমি সত্যি তোমাকে
চিঠিটা দিয়েছিলাম। মজা করার জন্য না।
আর কে বলল, তুমি দেখতে ভাল না? দেখো
তোমার আর আমার গায়ের রঙ একই।
আমার মাঝে মাঝে কথা বলতে গেলে কথা আটকে
যায়, সাহস কম, ঘুমালে চোখে দেখিনা ,দিনে পাঁচ বার
গোসল করি তাই বারো মাস সর্দি থাকে। আমাকে
ভালবাসা যাবে তো এতো কিছুর পরও?
প্রহেলি আলতো করে একটা হাসি দেয়। অক্ষের
চোখের দিকে তাকাতে খুব লজ্জা করে। চিঠিটা
নিয়ে দৌড়ে চলে যায়।
সব বন্ধুদের সকল কথাকে উপেক্ষা করে,
প্রহেলির সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যায় অক্ষ। প্রহেলি
মাঝে মাঝে খুব বিষণ্ণ হয়ে থাকত।
অক্ষকে বলত, তোমাকে খুব বাজে কথা বলে
আমার সাথে প্রেম করাতে তোমার বন্ধুরা। তাই না?
- আরে ধুর। কে কী বলবে? আর কার কথায় কী
আসে যায়? আমি ভালবাসি তোমাকে।
এই ভালবাসাটা এসেছিল হয়ত সেদিন রাতেই যেদিন
বন্ধুরা খুব অপমান সূচক কথা বলছিল প্রহেলিকে
উদ্দেশ্য করে।
প্রহেলির প্রচণ্ড অপমানে চলে যাওয়াটা মনের ভিতর
গেঁথেছিল অক্ষের। কেমন একটা অধরা মায়া
লেগেছিল মেয়েটার জন্য।
সে মায়া করুণা হয় নি। হয়েছিল ভালবাসা। সব মায়া করুণা হয়
না, কিছু মায়া ভালবাসার প্রকাশ।
ঈশার সাথে দেখা হত এরপর মাঝে মধ্যে। কখনও
বুকের ভিতর আর কাঁপন আসে নি,
একটা সময় রাত জেগে ভাবত ঈশাকে নিয়ে, সে
চিন্তাও আসে নি। মনে হত প্রহেলি বড় ভাল।
প্রহেলিকেই বড় ভালবাসে।
প্রহেলিকে নিয়ে ভাল আছে অক্ষ।

ঈশার সাথে সম্পর্ক হয়েছিল মাসুদের।
সে সম্পর্ক দেখেই পরিষ্কার হয়েছিল কেন মাসুদ
করেছিল কাজটা। অবশ্য এ জন্য মাসুদকে একটা
ধন্যবাদ দেয়া উচিৎ।
ঈশার সাথে সম্পর্ক হলে প্রহেলিকে কখনই পেত
না অক্ষ। ঈশার সাথে মাসুদের সম্পর্ক টিকে নি। তিন
মাস পরেই ভাঙন।
এরপর ভার্সিটি জীবনটায় দেখেছে ঈশার বহুজনের
সাথে যাওয়া আসা।
কিন্তু প্রহেলির সাথে সম্পর্ক টিকে ছিল, টিকে
আছে। অক্ষ জানে সারাজীবন থাকবে এ ভালবাসা।
সকাল বেলা ঘুম ভাঙে প্রহেলির ডাকেই। চা এনে
বসে অক্ষের পাশে। একটু চুমুক দিয়ে অক্ষের
দিকে বাড়িয়ে দেয়, নাও।
এই কাজটা প্রতিদিন সকালেই করে। এক কাপ ( ১
সেরের মগ ) দুজনে ভাগাভাগি করে খায়।
প্রহেলিই হাসে মিটিমিটি এ সময়টায়। অক্ষ প্রহেলির
হাত ধরে বলে, প্রহেলি, তোমার কী কখনও
মনে হয় আমার সাথে খারাপ আছ?
- কী বলছ এসব? খারাপ থাকব কেন?
- এই যে ঘরে তুমি সারাদিন একা থাকো, আমাদের
কোন বাচ্চা কাচ্চা নেই।
প্রহেলির মুখটা শুকিয়ে যায়। অক্ষের হাতটা আরও
শক্ত করে ধরে বলে, না। আমি তোমাকে নিয়ে
ভাল আছি। তুমি আমাকে অনেক ভাল রেখেছ।
অক্ষ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
- আমাকে যদি কখনও বিরক্ত লাগে বলে দিও। বলে
অক্ষ।
প্রহেলি চায়ের কাপটা রেখে, অক্ষকে জড়িয়ে
ধরে বলে, বিয়ের ছয় বছর পরে এই কথা বলছ?
তুমি না আসলেই একটা পাগল।
অক্ষের মনে আছে, বিয়ের যখন তিন বছর পরেও
যখন কোন বাচ্চা কাচ্চা হচ্ছিল না, প্রহেলির।
প্রহেলিকার জোরাজুরিতেই ডাক্তারের কাছে
যেতে হয় দুজনের। অক্ষ বলেছিল, থাক না, কী
দরকার?
তবুও দুজনে ডাক্তারি পরীক্ষা করায়। রিপোর্ট
যেদিন দেয়, অক্ষ রিপোর্ট হাতে এসে ছলছল
চোখে তাকিয়ে থাকে, প্রহেলির দিকে।
এতো বড় ছেলে, বাচ্চা মানুষের মত কান্না করে।
কান্না করে বলে, প্রহেলি আমাদের কখনও বাচ্চা
হবে না।
আমি কখনও তোমাকে বাচ্চা দিতে পারব না। ডাক্তার
বলেছে আমার বাবা হবার ক্ষমতা নেই।
প্রহেলি শক্ত করে সেদিন অক্ষকে জড়িয়ে
থাকে। অক্ষকে সান্ত্বনা দেবার বিপরীতে নিজেই
কাঁদে।
কেঁদে কেঁদে বলে, আরে বাচ্চা না হলে কী
হয়? কিছুই হয় না।
এ সংসারে ভালবাসা আছে। সে ভালবাসা বুঝে উঠবার
ক্ষমতা সবার নেই।

অফিসের লাঞ্চের সময়ে বের হয় অক্ষ। একটু শপিং
মলে যাওয়া দরকার। প্রহেলিকে একটা মেসেজ
পাঠিয়ে দেয়, আমি এখন মিটিং এ আছি। বেরিয়ে কল
দিব তোমাকে।
শপিং মল থেকে লিপস্টিক, ক্রিম, পাউডার, পারফিউম,
কানের দুল, নাক ফুল কিনে অক্ষ।
বিয়ের পরদিনও এমন বেরিয়েছিল প্রহেলিকে
নিয়ে। প্রহেলি বার বার বলছিল, অক্ষ আমার ভয়
করছে। তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?
- যাবো না, কথা দিচ্ছি।
ভয় হতেই পারে। প্রহেলিকার ছবি যখন বাসায় দেখায়
অক্ষ, পরিবারের কেউ রাজী ছিল না। এই
মেয়েকে ঘরের বউ করা অসম্ভব।
পরিবারের অমতেই বিয়ে করে প্রহেলিকে অক্ষ।
ছোটখাটো একটা চাকরি করে তখন। সে চাকরি
দিয়ে কোনমতে ছোট একটা বাসা নিয়ে থাকত।
প্রহেলিকার ভয় ছিল, পরিবারের অমতে বিয়ে
করেছে, যদি কখনও হঠাৎ মন বদলে যায়? তখন
প্রহেলির কী হবে? মন বদলায় নি।
এখনও প্রহেলিকার সাথেই আছে। সারাক্ষণ চেষ্টা
করে যাচ্ছে, বুঝাতে চাচ্ছে, প্রহেলিকে
ভালবাসে,
প্রহেলি সত্যি ভালবাসার মত একটা মেয়ে,
প্রহেলিকে নিয়ে অক্ষ খুব সুখী, প্রহেলিকে
পেয়ে অক্ষ খুব ভাগ্যবান।
শপিং মল থেকে জিনিস গুলো নিয়ে বের হয়ে,
একটা কুরিয়ার অফিসে গেল।
সেখান থেকে পার্সেল করে জিনিস গুলো
গোপালগঞ্জ পাঠাল। গোপালগঞ্জের বন্ধু
শাওনকে কল করে বলল, যে গুলো পাঠালাম জিনিস
হাতে পেয়ে আবার আমার বাসার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিস।
ফোন নাম্বার আমি যেটা বলছিলাম ওটা দিবি। তোর নাম
দিবি না, ঠিক আছে?
- এতো ভালবাসিস কেন প্রহেলিকে?
- ভালবাসি তাই ভালবাসি। ভালবাসতে কারণ লাগে না। ঘৃণা
করতে কারণ লাগে।
- তোদের দেখে মাঝে মাঝে হিংসা হয়। আমার
তো রিমার সাথে সারাদিন ঝগড়া। শালা একদিন তোদের
সংসারেও ঝগড়া লাগিয়ে দিব দেখিস।
- হাহা আচ্ছা লাগিয়ে দিস।

অক্ষ আবার ফিরে যায় অফিসে। দুই তিন দিন পর আবার
প্রহেলির ঠিকানায় একটা কুরিয়ার যাবে, গোপালগঞ্জ
থেকে।
প্রহেলিকে দেয়া থাকবে কিছু উপহার। অক্ষ তখন
বলবে, হয়ত তোমাকে কেউ পছন্দ করে সে
পাঠিয়েছে।
প্রহেলির তখন একবার হলেও মনে হবে,
প্রহেলিকা নিজেকে নিয়ে যতটা হীনমন্যতায় ভুগে
প্রহেলি মোটেও অতটা তেমন নয়।
প্রহেলির অক্ষ ছাড়াও কেউ কেউ ভালবাসে।
প্রহেলি ভালবাসা যায়। প্রহেলি ভালবাসার মত মেয়ে।
একা থাকা সংসারে প্রহেলির একা দিন রাতে নানা বাজে
চিন্তা আসতেই পারে, অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ নিয়ে।
প্রহেলিকা একটু ব্যস্ত থাকুক, অন্য চিন্তায়। নিজের
প্রতি সম্মান বাড়ুক। বাড়ুক অক্ষের ভালবাসা প্রহেলির
প্রতি।
মোবাইলে মেসেজ গুলোও পাঠাত অক্ষ, একটা
সিম থেকে যে সিম কিনা বন্ধ থাকত বাকিটা সময়
মেসেজ পাঠাবার।
ফুল গুলোও পাঠাত অক্ষ। অফিস থেকে ফেরার
পথে কিনে নিয়ে আসত।
আর গেটের দারোয়ানকে কিছু টাকা দিয়ে বলত,
একদম ভোর বেলা অক্ষদের ফ্ল্যাটের সামনে
রেখে আসতে।
আর দারোয়ানকে দিয়েই লেখাতো কাগজের
প্রহেলিকে উদ্দেশ্য করে লেখাটা।
অক্ষ চায় প্রহেলি ভাল থাকুক, ভালবাসুক, কখনও কষ্ট না
পাক। তাই কিছু মিথ্যে, কিছু অভিনয়ে দিন রাত চলে
যাচ্ছে।
সবচেয়ে মিথ্যেটা ছিল, ডাক্তারের রিপোর্টটা। সে
রিপোর্টে ছিল, মা হবার ক্ষমতা নেই প্রহেলিকার ।
অক্ষের কোন সমস্যাই নেই ।
এ কথা মানতে বা সহ্য করতে পারবে না প্রহেলিকা।
তাই মিথ্যেটা বলেছিল, যেন ঘৃণা আসলে আসুক
অক্ষের প্রতি। আর ঘৃণা না বাড়ুক প্রহেলির নিজের
প্রতি।

আবার একটা পার্সেল এসেছে প্রহেলিকা কাছে।
পার্সেলে আছে লিপস্টিক, ক্রিম, পাউডার, পারফিউম,
কানের দুল, নাক ফুল।
প্রহেলিকা মাথা দুই পাশে নেড়ে ছোট করে একটা
নিঃশ্বাস ফেলল। খুব যত্ন করে টেবিলে সাজিয়ে
রাখল জিনিস গুলো।
অক্ষ আসলেই একটা পাগল। প্রহেলিকে ভাল রাখার
জন্য, বুঝাবার জন্য অক্ষ ছাড়াও পছন্দ করে কেউ
প্রহেলিকে, তাই কত কিছু করছে। প্রহেলি হাসে।
অক্ষের মিথ্যে অভিনয়টা অনেক আগেই বুঝতে
পেরেছে প্রহেলি। মেসেজের ব্যাপার
থেকেই শুরু।
মেসেজ দেখেই কেন যেন মনে হত অক্ষ
পাঠায়। শুধু মনে হওয়াই।
একদিন অক্ষ অফিসে যাবার আগে যখন বাথরুমে যায়
গোসল করতে, প্রহেলি অফিসে যাবার শার্ট প্যান্ট
খুঁজে পায় একটা সিম।
চালু করে দেখে, এই সিম থেকেই মেসেজ
আসে। বলে না কিছু প্রহেলির। ফুলও পাঠাতো
অক্ষ, ব্যাপারটা জানে দারোয়ানের কাছ থেকেই
কিছু টাকা দিয়ে।
আর পার্সেলে পাঠানো শাড়িটা, অক্ষ প্রহেলিকে
যে দোকান থেকে সবসময় শাড়ি কিনে দেয় সে
দোকানেরই।
প্রহেলিকা জানে মিথ্যা বলেছে বাচ্চা হবার ব্যাপার খানা
নিয়েও। প্রহেলিকার ডাক্তার বান্ধবীকে দিয়ে
রিপোর্ট দেখিয়ে আবার জেনেছিল, সমস্যা
প্রহেলিকারই।
প্রহেলির মাঝে মাঝে খুব কান্না পায়। ভাবে এতো
ভাল কী করে একটা মানুষ একজনকে বাসতে
পারে?
প্রহেলি অক্ষের মিথ্যে গুলো বুঝতে পেরেও
কখনও বলে না কিছু। অক্ষ থাকুক ব্যস্ত ওর ভালবাসার
মানুষটাকে আরও ভালবাসায়।
প্রহেলি থাকুক ব্যস্ত, অক্ষের মিথ্যে কিছু ব্যস্ততার
অভিনয়ে। ভালবাসা বাড়ুক দুজনের মাঝে এ অভিনয়ের
মিথ্যে ঘিরে।

কিছু অভিনয়ে , কিছু মিথ্যেতে কিছু হয় না। কিছু অভিনয়,
কিছু মিথ্যেতে পাপ নেই।
কাউকে ভাল রাখার, কেউ ভাল থাকার যে সুখ গুলো,
মায়া গুলো এ অভিনয়, এ মিথ্যে ছুঁয়ে আসে তা
অমূল্য। মায়া বড় অদ্ভুত জিনিস।
কিছু মায়া এমন ভালবাসা হয়ে ধরা দেয়, তা কাটিয়ে উঠা
কখনই হয় না। কখনও পারাও যায় না।
বরং আরও বেশী আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরে,
ভালবাসা বাড়ায়।
অভিনয়, মিথ্যে আর মায়ার বেড়াজালে, একটা ঘোরে
ভালবাসাকে আটকে রাখে।
এ অধরা মায়া, এ ভালবাসা হয়ত সবার জন্য নয়।

No comments

Theme images by fpm. Powered by Blogger.