ভালবাসি না বলেও, ভালবেসে যায়। কেউ আবেগ লুকিয়ে, কেউ আবেগ দেখিয়ে।
রাগী রাগী মুখে বারান্দায় দাড়িয়ে
আছে অথৈ। খোলা বারান্দা না,
রেলিং দিয়ে ঘেরা বারান্দা।
রেলিং এর ফাঁক দিয়ে, দেখা যাচ্ছে
নীল হাফ হাতা,আর খয়েরি রঙের টি
শার্ট পরা ছেলেটাকে। দাড়িয়ে আছে।
দাড়িয়েই থাকবে। মোটা ফ্রেমের
চশমাটা হাতে নিয়ে, বার বার অথৈ এর
দিকে তাকাচ্ছে মিটিমিটি চোখে।
আর একটু পর পর মোবাইলটা বের করে
কাউকে কল করছে। অথৈ জানে কলটা
ওকেই করছে। কিন্তু কল ঢুকবে না,
নাম্বার বন্ধ করে রাখা। সেই ভোর
বেলা থেকে বলছে, বারান্দায় আসতে।
কল করেই বলে, হ্যালো অথৈ।
- হ্যাঁ। বল।
- একটু বারান্দায় আসবে?
- কেন?
- তোমাকে একটু দেখব।
- আমাকে দেখার কিছু নেই। আসতে
পারব না।
- আসো না একটু। দেখতে ইচ্ছা করছে।
- পারব না বললাম তো। আমি কি
তোমাকে আসতে বলছি?
- না তা বল নি।
- তাহলে আসছ কেন?
- এই মাঝে মাঝে দেখতে ইচ্ছা করে।
তাই চলে আসি। তোমার কাছে অনুমুতি
নিতে গেলে তো, তুমি না করবে।
- আমি এখন ঘুমাব। আমার ঘুম শেষ হয়
নি। তুমি চলে যাও।
- দেখো, এতো দূর থেকে আসলাম। এসেই
যখন পড়ছি, একটু বারান্দায় আসো।
- তুমি বললেই আসতে হবে? আসতে পারব
না। যাও তুমি।
অথৈ কেটে দেয়। মোবাইল সাইলেন্ট
করে, ঘুম দেয় অথৈ। ঘণ্টা খানেক পর ঘুম
থেকে উঠেও দেখে, মোবাইলের
স্ক্রিনে ভাসছে তুহিনের নামটা।
বাহিরে দাড়িয়ে থাকা, ছেলেটার
নাম তুহিন। খুব দূরের কেউ না অথৈর।
কাছের একটা মানুষ। কাছের মানুষ তবুও
কাছে আসতে দেয় না। কেন যেন দূরত্ব
রাখে। কল ধরে বলে, তুমি এখনও যাও
নি?
- না। আমি আজকে আসলে ফ্রি তো,
কোন কাজ নেই। তাই ভাবলাম,
তোমাকে একবার দেখে যাই। এখন
তোমার বাসার সামনে বসে বসে চা
খাচ্ছি। তোমাদের এখানকার চা অনেক
ভাল। এখন পর্যন্ত তিন কাপ খেলাম।
- তোমাকে চলে যেতে বলছি, তুমি বসে
আছ কেন? আমি বারান্দায় আসতে পারব
না, বললাম তো।
- সারাদিনে তো একবার আসবে। আমি
এখন বলছি না। দুপুরে গোসল করে, কাপড়
শুকাতে আসবে না? তখন তোমাকে
দেখব, আচ্ছা?
- তুহিন।
- হ্যাঁ বল।
- আচ্ছা আমি বারান্দায় আসছি। তুমি
চশমা খুলে, আমাকে দেখবে।
- আমি চশমা ছাড়া দেখি না কিছু,
অথৈ। তুমি জানো।
- তাহলে আমি আসব না। তুমি চশমা
ছাড়াই আমাকে দেখবে।
- আচ্ছা। আসো।
অথৈ বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। আর
চশমা ছাড়া মিটিমিটি চোখে
তাকাচ্ছে তুহিন। অথৈ জানে কিছুই
দেখতে পাচ্ছে না ছেলেটা। ঝাপসা
চোখে বারান্দার দিকে তাকিয়ে
আছে। অথৈ এটা কেন করছে জানে না।
তবুও ভাল লাগছে, এই ভেবে তুহিন ওর
কথা শুনছে। কথা শুনে, চশমা খুলে
তাকিয়ে আছে অথৈর দিকে। অথৈর
ইচ্ছা করে না তুহিনকে দেখতে তা না।
তবুও অথৈ আসতে বলে নি। নিজে থেকে
বাসার সামনে এসে কেন, পাগলামি
করবে? কেউ অথৈর কথা না শুনলে রাগ
হয় খুব। অনেক রাগ। অথৈর আবেগের
চেয়ে জেদ বেশী। জেদ ধরে রাখে, পুষে
রাখে। মানতে পারে না এটা, কেউ কথা
শুনবে না। তুহিনকে চলে যেতে বলল,
যায় নি। কথা শুনে নি। তাই এখন কথা
শুনিয়ে নিচ্ছে, জেদ করে চশমা খুলে
দাড় করিয়ে রাখছে তুহিনকে। তুহিন
ঠিক বন্ধু না অথৈর। বন্ধুর চেয়ে বেশী
কিছু। বন্ধুর জন্য যে অনুভূতি গুলো কাজ
করে, তুহিনের জন্য তার চেয়ে বেশী
কিছু করে। তুহিনের ক্ষেত্রেও একই
কথা। তবুও তুহিন আবেগ গুলো দেখিয়ে
দিতে পারে, অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে
পারে। অথৈ তা পারে না। করে না।
তুহিনের অথৈকে দেখতে ইচ্ছা করলেই,
চলে আসে বাসার সামনে। কিন্তু অথৈ
কখনও বলতে পারে না, বাসার সামনে
আসো, তোমাকে দেখব। সবাই হয়ত
পারে না আবেগ গুলো দেখাতে,
অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে। কিংবা
কখনও বুঝতেই পারে না। ভিতরে ভিতরে
অনুভূতিগুলো বেড়ে উঠছে। অনেক করে
কিছু চাইছে। অথৈ সেই দলের। এই যে
মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে দাড়িয়ে আছে।
রাগে রাগে তাকিয়ে আছে তুহিনের
দিকে। তবুও কেন যেন ভাল লাগছে। এই
ভাল লাগাটা আসলে, লাগাতে চায় নি
অথৈ। তবুও লাগছে। অথৈ মায়ায় বাধতে
চায় না কখনও। তবুও বুঝতে পারে, তুহিন
ছেলেটার মায়ায় দিন দিন বেধে
যাচ্ছে। তাই দূরে দূরে রাখে, তুহিনকে।
খারাপ ব্যাবহার করে, চায় খারাপ
ভাবুক অথৈ কে। কিন্তু তুহিনের সাথে
যতই খারাপ ব্যাবহার করুক, তুহিন মুখে
একটা হাসি ফুটিয়ে বসে থাকে। যাই
বলুক, হাসি মুখে করে ফেলে। অনেক রাগ
দেখালেও বলে, এতো রাগ কর কেন
আমার সাথে?
তবুও কখনও বিরক্তি দেখায় না তুহিন।
অথৈর অনেক বিরক্তির পরও না। এখন কল
করে যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে তুহিন। অথৈ
বন্ধ করে রেখেছে, ফোন। তবুও বিরক্ত
হচ্ছে না। করেই যাবে জানে। অথৈ
ফোন অন করবে না। করুক যত খুশি। কে
বলেছে আসতে? একটা সময় অথৈ নিজেই
কথা বলত অনেক তুহিনের সাথে। বন্ধু
হিসেবে। অনেক কাছের কেউ হয়ে
গিয়েছিল অল্প কয়েকদিনেই। সব বলত
তুহিনকে। একটা সময় অথৈ টের পাচ্ছিল,
তুহিনের জন্য মনের ভিতর অন্য কিছু
কাজ করছে। তুহিনের সাথে সারাক্ষণ
কথা বলতে ইচ্ছা করে। তুহিনের মুখে
অন্য কোন মেয়ের কথা শুনলেই রাগ
লাগে। কিছু একটা কাজ করে তুহিনের
জন্য। এই জিনিসটা চায় নি অথৈ। তবুও
মনের ভিতর কখন যেন তৈরি হয়ে
গিয়েছে। অথৈর সাথে এসব যায় না।
অথৈ আবেগ অনুভূতিহীন শক্ত মেয়ে।
অথৈ তাই জানে। কারও প্রতি দুর্বলতা
আসুক, কখনও চায় নি অথৈ। তাই দূরে
সরে যায় আস্তে আস্তে। কিন্তু তুহিন
সেই আগের মতই রয়ে যায়। কখনও
অভিযোগের সুরে এই কথাটা পর্যন্ত বলে
না, তুমি অনেক বদলে গেছ অথৈ।
ছেলেটা কেমন যেন। শুধু শুধু মায়া
বাড়িয়ে দেয়। তাই যত দূরেই রাখতে
চাক, মিথ্যে রাগ ফুটাক, তবুও কাছের
কেউ তুহিন।
তুহিন এখনও ঝাপসা চোখে বারন্দার
দিকে তাকিয়ে। দেখতে পারছে না
অথৈ কে, তবুও মনে মনে অনুভব করতে
পারছে। ভাল লাগছে তাতেই। অথৈ
চলে যাবে এখন বারান্দা থেকে। অনেক
দেখেছে তুহিন। আর দেখার দরকার নেই।
চারপাশটা কালো হয়ে আসছে। এখনকার
সময়টা বড় আজব। হুটহাট কালো মেঘে
চারপাশ অন্ধকার হয়ে, ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে
যায়। এখনও বৃষ্টি হবে মনে হয়। বলতে না
বলতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। ঝুম বৃষ্টি।
তুহিন সেই বৃষ্টির মাঝে দাড়িয়ে, এখনও
তাকিয়ে আছে বারান্দার দিকে। এমন
একটা ভাব যেন, বৃষ্টি হচ্ছে টেরই
পাচ্ছে না। অথৈ ঘরে চলে আসল।
তুহিন বৃষ্টিতে ভিজেও মোবাইলটা
টিপে যাচ্ছে। বৃষ্টির পানি ঢুঁকে অনেক
আগেই বন্ধ হয়ে গেছে যদিও। বারান্দায়
কি এখনও দাড়িয়ে আছে, অথৈ? বৃষ্টিতে
ভিজতে দেখছে তুহিনকে? এসব ভাবতে
ভাবতেই কারও কথার শব্দ কানে আসল।
এই শব্দটা অনেক পরিচিত।
- বৃষ্টিতে এভাবে ভিজছ কেন?
- না, আমি তো ভাবলাম তুমি এখনও
বারান্দায়।
- না আমি বারান্দায় না। অনেক আগেই
চলে গেছি ঘরে। চশমা পর।
তুহিন চশমা পরে সামনে দাঁড়ান অথৈর
দিকে তাকাল। চোখে অনেক শান্তি
লাগছে কেন যেন। একটা ছাতা মাথায়
দাড়িয়ে আছে অথৈ। এলোমেলো চুলে
আরও বেশীই সুন্দর লাগছে অথৈকে।
অথৈর দিকে তাকিয়ে তুহিন বলল,
তোমাকে সুন্দর লাগছে।
- জানি। বলতে হবে না।
তুহিন দেখল, বৃষ্টি বেড়েই চলেছে। ভাল
লাগছে ভিজতে খুব। অথৈকে নিয়ে
ভিজলে আরও ভাল লাগবে। একদম বৃষ্টি
বিলাস।
- অথৈ। আজকের বৃষ্টিটা অনেক ভাল
লাগছে। চল দুজন একসাথে ভিজি।
- না। আমার কোন ইচ্ছা নেই। নাও,
ছাতা নাও। ভিজো না আর বৃষ্টিতে।
ছাতা নিয়ে বাসায় যাও।
অথৈ তুহিনের দিকে, অন্য হাতে থাকা
ছাতাটা বাড়িয়ে দিল। তুহিন বৃষ্টি
বিলাসের ভাবনা বাদ দিয়ে, ছাতাটা
নিয়ে নিল। মেলে মাথায় দিল। অথৈ
বলল, যাও তাহলে, আসি।
তুহিন কিছুক্ষণ মাথা চুলকে বলল,
তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছিলাম।
- কি?
তুহিন পকেটে হাত ঢুকিয়ে, একটা
শিউলি ফুলের মালা বের করল।
- তোমার তো অনেক পছন্দ শিউলি ফুল।
তাই।
- তোমাকে আমি আনতে বলছি?
- না।
- তাহলে আনলে কেন?
- এমনি। ফেলে দিব এখন তাহলে?
- না, দাও।
তুহিন একটু হেসে মালাটা অথৈর হাতে
দিল। অথৈ রাগী রাগী মুখেই মালাটা
নিয়ে বলল, যাও এখন। আমিও ঘরে
যাচ্ছি।
অথৈ হাঁটতে লাগল। ছাতা মাথায়
দিয়ে। আর তুহিন অন্য ছাতা মাথায়
দাড়িয়ে আছে। অথৈ বাসায় ঢুঁকে
গেলেই, চলে যাবে তুহিন। ছাতা মাথায়
দিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে।
ভাল লাগায় ভাসতে ভাসতে। তুহিন
অল্পতেই খুশি। কিন্তু আজ অনেক
পেয়েছে। অথৈ বারান্দায় দাঁড়াল।
দেখা করল। ছাতা দিয়ে গেল। শিউলি
ফুল গুলো নিল। সত্যি অনেক পাওয়া।
আবার মনে পড়লে কোনদিন, দেখতে
ইচ্ছা করলে, এভাবে বাসার সামনে
দাড়িয়ে থাকবে। অথৈ অনেক বিরক্তি
দেখালেও, জানে তুহিন ঠিক দেখা
করবে। অনেক রাগ অভিমানের পিছনের
ভালবাসা টের পায় তুহিন।
অথৈ এসে আবার বারান্দায় দাঁড়াল।
ছাতা মাথায় হেটে যেতে দেখছে
তুহিনকে। ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। খুব
বৃষ্টি হচ্ছে। অথৈরও কেন যেন ভিজতে
ইচ্ছা করছে। মনে হচ্ছে, একবার ডাক
দিক পিছন থেকে তুহিনকে। ডেকে বলুক,
চল আজ আমরা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে
হাঁটি দুজন। হাতে হাত রেখে। তুমি
কিন্তু চশমা খুলে হাঁটবে। না দেখলে
আমি তোমার হাত ধরে ধরে নিয়ে যাব।
চশমা খুলে হাঁটবে কেন জানো? চশমার
ওপাশের তোমার চোখগুলো অনেক
সুন্দর।
তবে অথৈ কখনও এই কথা গুলো বলতে
পারবে না তুহিনকে। অথৈ মায়ায়
বাধতে চায় না। এই তো বেশ। রাগ
দেখিয়ে যাচ্ছে। সেই রাগের মাঝেও
তুহিন ভালবাসা পাচ্ছে। ভাললাগা
মানুষটার বেশী কাছে যেতে নেই। দূর
থেকে যা সুন্দর, গভীরে গেলে, তা
অসুন্দর হতেই পারে। তুহিনের অসুন্দর
কিছু দেখতে চায় না অথৈ। হয়ত বুকের
কোণের যে পবিত্র একটা বিশ্বাস,
সেটা হারাতে চায় না। জীবনের
জটিলতায় ভালবাসা হারিয়ে ফেলতে
চায় না। তুহিন ভালবাসে। অথৈ বাসে
নীরবে। কিছু সহজ সরল হিসেবে, এই
ভালবাসা বেঁচে রবে।
বৃষ্টির ভিতর চোখের আড়াল হয়ে গেল,
তুহিন। তবুও জানে, মনে আড়াল হয় নি।
কিছু মানুষ, আবেগ দেখাতে পারে না,
অনুভূতিগুলোর প্রকাশ করতে জানে না।
অথৈর মত কেউ মায়ায় বাধতে চায় না।
আর তুহিনের মত কেউ মায়া বাড়িয়েই
যায়। দূরে কিংবা কাছে, কিছু সম্পর্ক
এমন করে চলতে থাকে। মুখে যেখানে
বলাবলি নেই, ভালবাসি। শুধু অনুভব করে
দুজন। মুখে ভালবাসি বললে, বেধে
ফেলা হয়। ভালবাসতেই হবে, কাছে
থাকতেই হবে, এমন হিসেব কষা শুরু হয়ে
যায়। এর চেয়ে না বলে বুঝতে পারা,
অনুভব করা, বিশ্বাসে বেঁচে থাকা
ভালবাসা গুলো অনেক দামী।
ভালবাসি না বলেও, ভালবেসে যায়।
কেউ আবেগ লুকিয়ে, কেউ আবেগ
দেখিয়ে।
.
by
আদনান পারভেজ
আছে অথৈ। খোলা বারান্দা না,
রেলিং দিয়ে ঘেরা বারান্দা।
রেলিং এর ফাঁক দিয়ে, দেখা যাচ্ছে
নীল হাফ হাতা,আর খয়েরি রঙের টি
শার্ট পরা ছেলেটাকে। দাড়িয়ে আছে।
দাড়িয়েই থাকবে। মোটা ফ্রেমের
চশমাটা হাতে নিয়ে, বার বার অথৈ এর
দিকে তাকাচ্ছে মিটিমিটি চোখে।
আর একটু পর পর মোবাইলটা বের করে
কাউকে কল করছে। অথৈ জানে কলটা
ওকেই করছে। কিন্তু কল ঢুকবে না,
নাম্বার বন্ধ করে রাখা। সেই ভোর
বেলা থেকে বলছে, বারান্দায় আসতে।
কল করেই বলে, হ্যালো অথৈ।
- হ্যাঁ। বল।
- একটু বারান্দায় আসবে?
- কেন?
- তোমাকে একটু দেখব।
- আমাকে দেখার কিছু নেই। আসতে
পারব না।
- আসো না একটু। দেখতে ইচ্ছা করছে।
- পারব না বললাম তো। আমি কি
তোমাকে আসতে বলছি?
- না তা বল নি।
- তাহলে আসছ কেন?
- এই মাঝে মাঝে দেখতে ইচ্ছা করে।
তাই চলে আসি। তোমার কাছে অনুমুতি
নিতে গেলে তো, তুমি না করবে।
- আমি এখন ঘুমাব। আমার ঘুম শেষ হয়
নি। তুমি চলে যাও।
- দেখো, এতো দূর থেকে আসলাম। এসেই
যখন পড়ছি, একটু বারান্দায় আসো।
- তুমি বললেই আসতে হবে? আসতে পারব
না। যাও তুমি।
অথৈ কেটে দেয়। মোবাইল সাইলেন্ট
করে, ঘুম দেয় অথৈ। ঘণ্টা খানেক পর ঘুম
থেকে উঠেও দেখে, মোবাইলের
স্ক্রিনে ভাসছে তুহিনের নামটা।
বাহিরে দাড়িয়ে থাকা, ছেলেটার
নাম তুহিন। খুব দূরের কেউ না অথৈর।
কাছের একটা মানুষ। কাছের মানুষ তবুও
কাছে আসতে দেয় না। কেন যেন দূরত্ব
রাখে। কল ধরে বলে, তুমি এখনও যাও
নি?
- না। আমি আজকে আসলে ফ্রি তো,
কোন কাজ নেই। তাই ভাবলাম,
তোমাকে একবার দেখে যাই। এখন
তোমার বাসার সামনে বসে বসে চা
খাচ্ছি। তোমাদের এখানকার চা অনেক
ভাল। এখন পর্যন্ত তিন কাপ খেলাম।
- তোমাকে চলে যেতে বলছি, তুমি বসে
আছ কেন? আমি বারান্দায় আসতে পারব
না, বললাম তো।
- সারাদিনে তো একবার আসবে। আমি
এখন বলছি না। দুপুরে গোসল করে, কাপড়
শুকাতে আসবে না? তখন তোমাকে
দেখব, আচ্ছা?
- তুহিন।
- হ্যাঁ বল।
- আচ্ছা আমি বারান্দায় আসছি। তুমি
চশমা খুলে, আমাকে দেখবে।
- আমি চশমা ছাড়া দেখি না কিছু,
অথৈ। তুমি জানো।
- তাহলে আমি আসব না। তুমি চশমা
ছাড়াই আমাকে দেখবে।
- আচ্ছা। আসো।
অথৈ বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। আর
চশমা ছাড়া মিটিমিটি চোখে
তাকাচ্ছে তুহিন। অথৈ জানে কিছুই
দেখতে পাচ্ছে না ছেলেটা। ঝাপসা
চোখে বারান্দার দিকে তাকিয়ে
আছে। অথৈ এটা কেন করছে জানে না।
তবুও ভাল লাগছে, এই ভেবে তুহিন ওর
কথা শুনছে। কথা শুনে, চশমা খুলে
তাকিয়ে আছে অথৈর দিকে। অথৈর
ইচ্ছা করে না তুহিনকে দেখতে তা না।
তবুও অথৈ আসতে বলে নি। নিজে থেকে
বাসার সামনে এসে কেন, পাগলামি
করবে? কেউ অথৈর কথা না শুনলে রাগ
হয় খুব। অনেক রাগ। অথৈর আবেগের
চেয়ে জেদ বেশী। জেদ ধরে রাখে, পুষে
রাখে। মানতে পারে না এটা, কেউ কথা
শুনবে না। তুহিনকে চলে যেতে বলল,
যায় নি। কথা শুনে নি। তাই এখন কথা
শুনিয়ে নিচ্ছে, জেদ করে চশমা খুলে
দাড় করিয়ে রাখছে তুহিনকে। তুহিন
ঠিক বন্ধু না অথৈর। বন্ধুর চেয়ে বেশী
কিছু। বন্ধুর জন্য যে অনুভূতি গুলো কাজ
করে, তুহিনের জন্য তার চেয়ে বেশী
কিছু করে। তুহিনের ক্ষেত্রেও একই
কথা। তবুও তুহিন আবেগ গুলো দেখিয়ে
দিতে পারে, অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে
পারে। অথৈ তা পারে না। করে না।
তুহিনের অথৈকে দেখতে ইচ্ছা করলেই,
চলে আসে বাসার সামনে। কিন্তু অথৈ
কখনও বলতে পারে না, বাসার সামনে
আসো, তোমাকে দেখব। সবাই হয়ত
পারে না আবেগ গুলো দেখাতে,
অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে। কিংবা
কখনও বুঝতেই পারে না। ভিতরে ভিতরে
অনুভূতিগুলো বেড়ে উঠছে। অনেক করে
কিছু চাইছে। অথৈ সেই দলের। এই যে
মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে দাড়িয়ে আছে।
রাগে রাগে তাকিয়ে আছে তুহিনের
দিকে। তবুও কেন যেন ভাল লাগছে। এই
ভাল লাগাটা আসলে, লাগাতে চায় নি
অথৈ। তবুও লাগছে। অথৈ মায়ায় বাধতে
চায় না কখনও। তবুও বুঝতে পারে, তুহিন
ছেলেটার মায়ায় দিন দিন বেধে
যাচ্ছে। তাই দূরে দূরে রাখে, তুহিনকে।
খারাপ ব্যাবহার করে, চায় খারাপ
ভাবুক অথৈ কে। কিন্তু তুহিনের সাথে
যতই খারাপ ব্যাবহার করুক, তুহিন মুখে
একটা হাসি ফুটিয়ে বসে থাকে। যাই
বলুক, হাসি মুখে করে ফেলে। অনেক রাগ
দেখালেও বলে, এতো রাগ কর কেন
আমার সাথে?
তবুও কখনও বিরক্তি দেখায় না তুহিন।
অথৈর অনেক বিরক্তির পরও না। এখন কল
করে যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে তুহিন। অথৈ
বন্ধ করে রেখেছে, ফোন। তবুও বিরক্ত
হচ্ছে না। করেই যাবে জানে। অথৈ
ফোন অন করবে না। করুক যত খুশি। কে
বলেছে আসতে? একটা সময় অথৈ নিজেই
কথা বলত অনেক তুহিনের সাথে। বন্ধু
হিসেবে। অনেক কাছের কেউ হয়ে
গিয়েছিল অল্প কয়েকদিনেই। সব বলত
তুহিনকে। একটা সময় অথৈ টের পাচ্ছিল,
তুহিনের জন্য মনের ভিতর অন্য কিছু
কাজ করছে। তুহিনের সাথে সারাক্ষণ
কথা বলতে ইচ্ছা করে। তুহিনের মুখে
অন্য কোন মেয়ের কথা শুনলেই রাগ
লাগে। কিছু একটা কাজ করে তুহিনের
জন্য। এই জিনিসটা চায় নি অথৈ। তবুও
মনের ভিতর কখন যেন তৈরি হয়ে
গিয়েছে। অথৈর সাথে এসব যায় না।
অথৈ আবেগ অনুভূতিহীন শক্ত মেয়ে।
অথৈ তাই জানে। কারও প্রতি দুর্বলতা
আসুক, কখনও চায় নি অথৈ। তাই দূরে
সরে যায় আস্তে আস্তে। কিন্তু তুহিন
সেই আগের মতই রয়ে যায়। কখনও
অভিযোগের সুরে এই কথাটা পর্যন্ত বলে
না, তুমি অনেক বদলে গেছ অথৈ।
ছেলেটা কেমন যেন। শুধু শুধু মায়া
বাড়িয়ে দেয়। তাই যত দূরেই রাখতে
চাক, মিথ্যে রাগ ফুটাক, তবুও কাছের
কেউ তুহিন।
তুহিন এখনও ঝাপসা চোখে বারন্দার
দিকে তাকিয়ে। দেখতে পারছে না
অথৈ কে, তবুও মনে মনে অনুভব করতে
পারছে। ভাল লাগছে তাতেই। অথৈ
চলে যাবে এখন বারান্দা থেকে। অনেক
দেখেছে তুহিন। আর দেখার দরকার নেই।
চারপাশটা কালো হয়ে আসছে। এখনকার
সময়টা বড় আজব। হুটহাট কালো মেঘে
চারপাশ অন্ধকার হয়ে, ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে
যায়। এখনও বৃষ্টি হবে মনে হয়। বলতে না
বলতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। ঝুম বৃষ্টি।
তুহিন সেই বৃষ্টির মাঝে দাড়িয়ে, এখনও
তাকিয়ে আছে বারান্দার দিকে। এমন
একটা ভাব যেন, বৃষ্টি হচ্ছে টেরই
পাচ্ছে না। অথৈ ঘরে চলে আসল।
তুহিন বৃষ্টিতে ভিজেও মোবাইলটা
টিপে যাচ্ছে। বৃষ্টির পানি ঢুঁকে অনেক
আগেই বন্ধ হয়ে গেছে যদিও। বারান্দায়
কি এখনও দাড়িয়ে আছে, অথৈ? বৃষ্টিতে
ভিজতে দেখছে তুহিনকে? এসব ভাবতে
ভাবতেই কারও কথার শব্দ কানে আসল।
এই শব্দটা অনেক পরিচিত।
- বৃষ্টিতে এভাবে ভিজছ কেন?
- না, আমি তো ভাবলাম তুমি এখনও
বারান্দায়।
- না আমি বারান্দায় না। অনেক আগেই
চলে গেছি ঘরে। চশমা পর।
তুহিন চশমা পরে সামনে দাঁড়ান অথৈর
দিকে তাকাল। চোখে অনেক শান্তি
লাগছে কেন যেন। একটা ছাতা মাথায়
দাড়িয়ে আছে অথৈ। এলোমেলো চুলে
আরও বেশীই সুন্দর লাগছে অথৈকে।
অথৈর দিকে তাকিয়ে তুহিন বলল,
তোমাকে সুন্দর লাগছে।
- জানি। বলতে হবে না।
তুহিন দেখল, বৃষ্টি বেড়েই চলেছে। ভাল
লাগছে ভিজতে খুব। অথৈকে নিয়ে
ভিজলে আরও ভাল লাগবে। একদম বৃষ্টি
বিলাস।
- অথৈ। আজকের বৃষ্টিটা অনেক ভাল
লাগছে। চল দুজন একসাথে ভিজি।
- না। আমার কোন ইচ্ছা নেই। নাও,
ছাতা নাও। ভিজো না আর বৃষ্টিতে।
ছাতা নিয়ে বাসায় যাও।
অথৈ তুহিনের দিকে, অন্য হাতে থাকা
ছাতাটা বাড়িয়ে দিল। তুহিন বৃষ্টি
বিলাসের ভাবনা বাদ দিয়ে, ছাতাটা
নিয়ে নিল। মেলে মাথায় দিল। অথৈ
বলল, যাও তাহলে, আসি।
তুহিন কিছুক্ষণ মাথা চুলকে বলল,
তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছিলাম।
- কি?
তুহিন পকেটে হাত ঢুকিয়ে, একটা
শিউলি ফুলের মালা বের করল।
- তোমার তো অনেক পছন্দ শিউলি ফুল।
তাই।
- তোমাকে আমি আনতে বলছি?
- না।
- তাহলে আনলে কেন?
- এমনি। ফেলে দিব এখন তাহলে?
- না, দাও।
তুহিন একটু হেসে মালাটা অথৈর হাতে
দিল। অথৈ রাগী রাগী মুখেই মালাটা
নিয়ে বলল, যাও এখন। আমিও ঘরে
যাচ্ছি।
অথৈ হাঁটতে লাগল। ছাতা মাথায়
দিয়ে। আর তুহিন অন্য ছাতা মাথায়
দাড়িয়ে আছে। অথৈ বাসায় ঢুঁকে
গেলেই, চলে যাবে তুহিন। ছাতা মাথায়
দিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে।
ভাল লাগায় ভাসতে ভাসতে। তুহিন
অল্পতেই খুশি। কিন্তু আজ অনেক
পেয়েছে। অথৈ বারান্দায় দাঁড়াল।
দেখা করল। ছাতা দিয়ে গেল। শিউলি
ফুল গুলো নিল। সত্যি অনেক পাওয়া।
আবার মনে পড়লে কোনদিন, দেখতে
ইচ্ছা করলে, এভাবে বাসার সামনে
দাড়িয়ে থাকবে। অথৈ অনেক বিরক্তি
দেখালেও, জানে তুহিন ঠিক দেখা
করবে। অনেক রাগ অভিমানের পিছনের
ভালবাসা টের পায় তুহিন।
অথৈ এসে আবার বারান্দায় দাঁড়াল।
ছাতা মাথায় হেটে যেতে দেখছে
তুহিনকে। ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। খুব
বৃষ্টি হচ্ছে। অথৈরও কেন যেন ভিজতে
ইচ্ছা করছে। মনে হচ্ছে, একবার ডাক
দিক পিছন থেকে তুহিনকে। ডেকে বলুক,
চল আজ আমরা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে
হাঁটি দুজন। হাতে হাত রেখে। তুমি
কিন্তু চশমা খুলে হাঁটবে। না দেখলে
আমি তোমার হাত ধরে ধরে নিয়ে যাব।
চশমা খুলে হাঁটবে কেন জানো? চশমার
ওপাশের তোমার চোখগুলো অনেক
সুন্দর।
তবে অথৈ কখনও এই কথা গুলো বলতে
পারবে না তুহিনকে। অথৈ মায়ায়
বাধতে চায় না। এই তো বেশ। রাগ
দেখিয়ে যাচ্ছে। সেই রাগের মাঝেও
তুহিন ভালবাসা পাচ্ছে। ভাললাগা
মানুষটার বেশী কাছে যেতে নেই। দূর
থেকে যা সুন্দর, গভীরে গেলে, তা
অসুন্দর হতেই পারে। তুহিনের অসুন্দর
কিছু দেখতে চায় না অথৈ। হয়ত বুকের
কোণের যে পবিত্র একটা বিশ্বাস,
সেটা হারাতে চায় না। জীবনের
জটিলতায় ভালবাসা হারিয়ে ফেলতে
চায় না। তুহিন ভালবাসে। অথৈ বাসে
নীরবে। কিছু সহজ সরল হিসেবে, এই
ভালবাসা বেঁচে রবে।
বৃষ্টির ভিতর চোখের আড়াল হয়ে গেল,
তুহিন। তবুও জানে, মনে আড়াল হয় নি।
কিছু মানুষ, আবেগ দেখাতে পারে না,
অনুভূতিগুলোর প্রকাশ করতে জানে না।
অথৈর মত কেউ মায়ায় বাধতে চায় না।
আর তুহিনের মত কেউ মায়া বাড়িয়েই
যায়। দূরে কিংবা কাছে, কিছু সম্পর্ক
এমন করে চলতে থাকে। মুখে যেখানে
বলাবলি নেই, ভালবাসি। শুধু অনুভব করে
দুজন। মুখে ভালবাসি বললে, বেধে
ফেলা হয়। ভালবাসতেই হবে, কাছে
থাকতেই হবে, এমন হিসেব কষা শুরু হয়ে
যায়। এর চেয়ে না বলে বুঝতে পারা,
অনুভব করা, বিশ্বাসে বেঁচে থাকা
ভালবাসা গুলো অনেক দামী।
ভালবাসি না বলেও, ভালবেসে যায়।
কেউ আবেগ লুকিয়ে, কেউ আবেগ
দেখিয়ে।
.
by
আদনান পারভেজ
No comments