Header Ads

"শাপমোচন"

নীল বর্ণ থেকে মরদেহটা ক্রমাগত কালচে রঙ ধারণ করছে। পুরনো শাড়ির ওপর নিথর দেহটা পড়ে আছে ঘন্টা দুয়েক থেকে। কানের নিচের জায়গাটায় ছোট্ট দুটি দাগ আর স্থানটি একটু ফুলে যাওয়া, কাছে থেকে দেখলে মনেহয় জায়গাটুকুতে পঁচন ধরেছে। পঁচনপ্রিয় মাছিগুলো সারা শরীরের ঘ্রাণ সংগ্রহ করলেও ক্ষতস্থানটিতে বসছে না কখনোই।

সময়ের সাথে সমবেদনা জানানোর মানুষ বেড়েই চললো। মরদেহে মানুষের আগ্রহ নেই, মরদেহের স্তন থেকে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য বারবার চৌদ্দ মাসের শিশুর প্রচেষ্টাই সকলের আগ্রহের কেন্দ্র। কান্না নেই, কৌতুহল নেই, উৎকণ্ঠা নেই শিশুটির মাঝে, আছে শুধু অধিকারসূত্রে ঐ স্তন থেকে ক্ষুধা নিবারণের প্রচেষ্টা।

প্রায় চার ঘন্টা পর থানার লোকদের সাথে এলাকার মেম্বারসহ কয়েকজন বসলো করণীয় সম্পর্কিত বৈঠকে। সাপে কেটেই মারা গেছে-এ বিষয়ে কারো দ্বিমত না থাকায় পুলিশ জানাযার আনুষ্ঠানিকতার অনুমতি দিল।

যোহরবাদ স্কুলের পূর্ব পাশেই দাফন করা হলো বিজলীর। দাফন হওয়ার থেকেই নতুন সন্দেহ সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে, বিশেষ করে বিজলীর শ্বশুর আমজাদ আলীকে। গত তিনবছরেই সাপে কেটে মারা গেলো ৫ জন, সবাই মেয়ে বা মহিলা। এলাকার সবাই বিশ্বাস করে আমজাদ আলীকে গ্রাম প্রধান মেনে চলে, এমনকি মেম্বার আনোয়ার শেখও উনাকে মেনে চলে সম্মানের সাথে। একমাত্র পূত্রবধূকে হারানোর চেয়েও বেশি ভাবাচ্ছে মৃতগুলো। ছেলে মোতালেবকে শান্তনা দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে আমজাদ আলী।

বিজলীর মৃত্যুর আটদিন পেরুলো আজ। ছোট ছেলেটাকে নিয়ে গেছে বিজলীর বাপের বাড়ির মানুষ। মোতালেবের বারণ খাটেনি আমজাদ আলীর অনুমতির কাছে। স্ত্রী হারানো আর ছোট্ট শিশুকে চোখের সামনে না দেখতে পারাটাই মোতালেবকে আহত করছে প্রতিটি মূহুর্তে।

উঠানেই বসে আমজাদ আলী, আছে মসজিদের ইমাম আব্দুস সোবহান মন্ডল, কুস্তি পালোয়ান নজির হোসেন। মাথা নিচু করেই মোতালেব আসলো সেখানে।
'কিছু কইবা বাজান'-কথা বললেন আমজাদ আলী।
'শহরে যামু আমি, এইহানে ফাপর আইছে আমার'-কণ্ঠ জড়িয়ে আসছে মোতালেবের।
আমজাদ আলীর কথা আসলো না, ইমাম সাহেব বললেন-'এইডা কি কয় বাপু?'
কথা বাড়ায় না মোতালেব।

রাতেই চলে গেছে মোতালেব, আটকানোর সামান্য চেষ্টাটুকুও ছিলনা আমজাদ আলীর। চোখের কোণে অশ্রু জমেছিলো কি না তা নিজেও জানেনা, জানে শুধু একা কাঠাতে হবে জীবনের বাকি পথটুকু। এ চরে প্রথম আসা মানুষ তিনি, স্ত্রী মারা গেছে, ছেলের বউ মারা গেছে, নাতিকেও নিয়ে গেছে, একমাত্র ছেলেও চলে গেলো।

চর ঢুষমারা। একসময় তিস্তা নদীর স্রোতের তীব্রতা যেখানটায় সবচেয়ে বেশি ছিল, সেখানেই এখন পাড়ের চেয়েও উঁচু চর। নদীর গতিপথের খেলায় অন্য দিকের ভাঙ্গন যতই বাড়ছে, চর ঢুষমারার উচ্চতা যেন ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভাসমান চরের দু'ধার দিয়ে বয়ে চলা তিস্তা যেন ভুলেই গিয়েছে এখানেও ভাঙ্গনের মতো কোন এলাকা আছে। প্রথম দিকটায় ভয়ে ভয়ে কয়েকঘর এখানে বসতি স্থাপন করলেও এখন ঘরের সংখ্যা প্রায় শ'দুই। দ্রুত বর্ধনশীল বৃক্ষের সবুজতা নদীর দু'ধার থেকে একটা দ্বীপ ভাবায় এ চরকে। সময়ের সাথে সাথে এখানে বেড়েছে নিজেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, বিশ্বাস, সম্প্রীতি। আকস্মিক কিছু মৃত্যু ছাড়া কারো কোন দুঃখ নেই, থাকলেও সেগুলো সম্প্রীতির কাছে হারে প্রতিনিয়ত।

সফলভাবেই আমন্ত্রণপত্র পৌঁছাতে পারলো উপজেলায়, আগামী সপ্তাহেই নতুন মসজিদের কাজ শেষ হবে চরে। নিজেদের টুকটাক কেনাকাটিতে সন্ধ্যা পেরিয়ে এখন প্রায় ১১ টা বাজে। নদীতীরে আমজাদ আলী, আনোয়ার শেখ, আব্দুস সোবহান, নজির হোসেন ও এলাকার আরো কিছু লোকের সমাগম। দশটার পরেই নৌকা বন্ধ করে হাতেম আলী, তাই এ অপেক্ষা। শীত মৌসুমে পানি কমে হাটুতে আসে, এখন প্রায় গলাপানি।
'ও হাতেম' নদীপাড় থেকেই নজির হোসেনের গগনবিদারী ডাক। বাতাস অনুকূলে থাকলে হাতেম আলী শুনবেই, এমন আশায় আরো কয়েকবার ডাকলো 'হাতেম, ও হাতেম।'
শব্দের তীব্রতায় নিজেদের কানেই ডাকগুলো আছড়ে পড়লো বারবার।
কিছু সময় পরেই ওপাড়ে ছোট্ট আলোর মতো দেখতে পেলেন সবাই। জ্যোৎস্না পেরিয়ে এখন অন্ধকার, তাই অল্প আলোও চোখে পড়ে।
'নজির মিয়া নাকি' ওপাড় থেকে হাতেম আলীর আওয়াজ।
'হ মিয়া, আহো' নজির হোসেনের উচ্চকণ্ঠের প্রত্যুত্তর।

দক্ষ বৈঠার মালিক হাতেম আলী। বেশিসময় লাগেনি নদী ডিঙ্গাতে।
'নাউ সাজাও হাতেম, বাইচ হইবো। এবার গরু পাইবা জিতলে।' বাড়ির পথ ধরে হাটতে হাটতেই বলেন আমজাদ আলী।
'হ চাচাজান, আর কয়ডা নয়া বৈঠা কিনলেই হইবো।'
'টেকা আছে?' পিছন না ফিরেই।
'হ চাচা, খালি দোয়া কইরেন।'

বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছলো চারজনই। থমকে দাড়ালো নজির হোসেন, দৃষ্টি একদিকেই নিবন্ধ।
'কি অইলো মিয়া?'-আনোয়ার শেখের আগ্রহী জিজ্ঞাসা।
'আমি কাউরে ও বাড়িত ঢুকবার দেখলাম'-হাত দিয়ে সামনের ওসমান দর্জির বাড়ি দেখালো নজির হোসেন।
'ধূর মিয়া, আন্দারে ভূত দেখছো তাইলে'-আমজাদ আলীর হাসিমাখা উত্তর।
'না না চাচাজান, লাইট মারছিলো একবার। আমি দেখছি কিন্তু'-আত্মবিশ্বাস নজির হোসেনের কণ্ঠে।
'কিন্তু ওসমান মিয়া তো গঞ্জে গেছে কামে, তাইলে কে আইলো?'-আনোয়ার শেখের আগ্রহ বেড়ে যায়।
'খাড়াও কিছুক্ষণ, তাইলেই বুঝন যাইবো'-আমজাদ আলী সজাগ দৃষ্টির উত্তর।

প্রায় দশ মিনিট পর ঘরের মাঝে আলো দেখা গেল। ছাউনী আর বেড়ার মাঝের সামান্য ফাঁকায় আলো-আধারির খেলায় বুঝতে অসুবিধা হলো ঘরে দু'জন মানুষ আছে। তড়িৎ গতিতে নজির হোসেন এগিয়ে গেলেন ঘরের দিকে, পিছনে বাকিরাও। আরো কিছুটা সময় নিয়ে ভিতরের কথা শোনার চেষ্টা করলেন সবাই, মৃদু আলাপন শুনতে পেলেও বুঝতে পারলেন না কেউ। দরজায় হাত দিয়ে টোকা দিলেন নজির হোসেন।

বেশ কিছুক্ষণ দরজায় শব্দ করলেন সবাই, কোন সাড়া নেই; আলো জ্বলছেই। নজির হোসেন তাকালেন আনোয়ার শেখের দিকে, কোন অনুমতি প্রার্থনা। মাথা নাড়িয়ে অনুমতি দিলেন মেম্বার। সজোড়ে দরজায় লাথি মারলেন নজির হোসেন।

ভাঙ্গা দরজার পাশেই আমজাদ আলী, ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। মেম্বার আনোয়ার শেখ ও নজির হোসেন পালোয়ান অর্ধনগ্ন মোতালেব ও হালিমাকে বেঁধেছে চৌকির পায়া'র সাথে। ভাষা নেই আব্দুস সোবহান সাহেবের মুখেও।
'কি করবা নজির মিয়া?' আমজাদ আলীর কাঁপা স্বর। একহাত দিয়ে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করছেন চৌকাঠ ধরে।
'আমি কি কমু চাচা?' মাথা নিচু করেই নিজের করণীয় জানতে চায় নজির।
চাঁপাকষ্টের হাসি হাসতে চায় আমজাদ আলী।
'মেম্বার, তুমি কও।'
আরো চমকালেন আনোয়ার শেখ। হাত দুটো মুখের সামনে মুষ্টিবদ্ধ করে ক্ষমা চাইলেন তিনি।
'বান্দন মজবুত কইরা ঘরে আগুন লাগাইয়া দাও নজির'-চোখ বেয়ে পানি আসলো আমজাদ আলীর।
'কি কও মিয়া? এইডা অধর্ম। কাউরে পোড়াইতে ধর্মে চরম মানা।' কিছুটা আতকে উঠেন ইমাম সাহেব।
'হ মিয়াভাই'-আনোয়ার শেখ সমর্থন করে।
'যা কইছি তাই কর নজির'-ভয়ঙ্করতা ভর করে আমজাদ আলীর কণ্ঠে।
'থানায় দিলে অয় না চাচা' আগের চেয়েও নিচু মাথায় নজির হোসেন।
'ও মিয়া, সাপের সঙ্গম দেইখা ফেললে ছোবল মারে, জোড়ার এক সাপরে মারলে বাকিডাও ছোবল মারে। তাই সাপরে মাইরা ফেলানি ভালা'।

নজির হোসেনকে বাঁধন মজবুত করার নির্দেশ দিয়ে ঘর থেকে বাহির হলেন আমজাদ আলী।
বাড়ির উঠোনে ইমাম সাহেব আমজাদ আলীর হাত ধরলেন-'ও মিয়া, আরেকবার ভাবলে অয় না?'
মুখ ঘুরিয়ে নিলেন আমজাদ আলী।

আগুনের ভয়াবহ রূপ ভেদ করে দু'জনের বাঁচবার আকুতি ভেসে আসছে বারংবার, কিছুটা দূরে মাটিতে বসে আমজাদ আলী শুনেই চলেছে সে ডাক। আগুনের ভেতরের সে আর্তনাদ যতই অপরাধীর হোক, সেটা তো সন্তানেরও ডাক।

আগুনের খেলাটা চললো না বেশিক্ষণ। ছুটে আসা সবাই ফিরে গেছে নিজেদের ঘরে। জেনে গেছে সবাই, ফিরবার পথে তাই একটাই শব্দ 'আহারে'।

ইমাম সাহেবও চলে গেছে বাড়িতে, আমজাদ আলী এখনোও মাটিতেই বসে। উঠলেন যখন, তখন প্রায় ভোর। নজির হোসেন আর আনোয়ার শেখের কাঁধে ভর দিয়ে ঘরের দিকে হাটতে শুরু করলেন আমজাদ আলী। ঘরে ঢুকবার পূর্ব মূহুর্তে মৃদু কণ্ঠে বললেন-'নজির মিয়া'।
থমকে দাড়ালেন নজির হোসেন ও আনোয়ার শেখ।
'চাচামিয়া'-কারণ জানবার আগ্রহ নজির হোসেনের।
'মাফ কইরা দিও আমারে।'
কথা বলার ভাষা নাই দু'জনের।
'আমার আর কেউ রইলো না মিয়ারা, আমারে দু'বেলা ভাত দিও তোমরা।'
কান্না থামাতে পারলেন না আমজাদ আলী। উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলেন।
'এই সাপরে না মারলে চরের বেবাক মানসেরে কামড় দিতো। আমার বংশ না থাকলেও হইবো, চরডাই আমার বংশ।'

বুকের উঠা-নামাটা দ্রুত হচ্ছে আমজাদ আলীর, নিঃশ্বাসের গাঢ়তা বাড়ছে। চোখের দু'ধার বেয়ে কিছুটা জল বালিশ খুঁজে নিয়েছে তাঁর।
মোতালেব!!!!
তাহলে কি সব মৃত্যু মোতালেবই ঘটিয়েছে? দ্বিফলা বর্শিতে বিষ মাখিয়ে সেই মেরেছে সবাইকে? হায় রে সাপ!! এ সাপ নয়, এ শাপ।

Shafiqul Islam Shapon

No comments

Theme images by fpm. Powered by Blogger.