Header Ads

অপরাহ্ণের হাসি

"অপরাহ্ণের হাসি"
মাহমুদুল হাসান রায়হান

মসজিদের দোতালার দরজাটা একটু নড়বড়ে।সেই নড়বড়ে দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো একজন বিশালদেহী মানুষ।মসজিদের মানুষগুলোর চোখ আমার মতোই বিশালদেহীর অধিকারী সেই মানুষটির উপর ছিলো না।তার সাথে প্রবেশ করেছিলো দুটি বাচ্চা ছেলে-মেয়ে।স্বাভাবিকভাবে সবার চোখ ছিলো বাচ্চা মেয়েটির উপর এটাও স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু আমি তাকিয়ে ছিলাম পাশের ছোট ছেলেটির উপর।বয়স একটু বেশি কম হওয়ায় আমার মনে হচ্ছিলো আজকে মসজিদের খাদেমের কাজ বাড়তে যাচ্ছে।

এই এলাকায় আছি বহুদিন কিন্তু কয়েকজন ছাড়া তেমন কারো সাথে কথাবার্তা বলি নাহ।শুক্রবার মসজিদের দোতালা হয়ে উঠে একটা আড্ডাবাজির জায়গা।আপাতত মসজিদ বলেই হয়তো এখানে কোনো হকার এসে চা বিক্রি শুরু করে নি।আমি তেমন পরিচিত নই বলে চুপচাপ বসে সবার অবস্থা দেখছি। কিন্তু আমার চিন্তা করার মানুষটি এখনো মসজিদে এসে পৌছান নি। আমার পাশে বসে আছে আমার পরিচিত একজন সদ্য যুবক ভাই। কিছুক্ষণ পর পর তার মেসেঞ্জার এর টুংটাং শব্দ বিরক্ত করছে। কিন্তু তিনি একমনে মোবাইল চালাতে ব্যস্ত সাথে মুচকি হাসিতেও ব্যস্ত সম্ভবত। তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন শুধু একটি ফুলের চাষ করেন তবে তার মেসেঞ্জার এর অতিরিক্ত টুংটাং শব্দে  মনে হচ্ছে বাগানের চাষ চলছে।

হঠাৎ সবাই একসঙ্গে একজনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। একজন এলাকার বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে এভাবে ছোট বড় সবাই হাসলে বড় ভাইটির সম্ভবত রেগে যাওয়ার কথা। কিন্ত নাহ বড় ভাইটিও সবার দিকে চেয়ে একটা হাসি দিয়ে বসে গেলেন। বড় ভাইটি সবার পরিচিত একজন মানুষ উনাকে সবাই নাস্তিক হিসেবে চিনে। সারা সপ্তাহ  নাস্তিকতা নিয়ে  এলাকার সবার মধ্যে তিনি তার বক্তব্য প্রচার করেন। কিন্তু সপ্তাহ শেষে শুক্রবার যখন বাসায় বাপের প্যাঁদানি খেয়ে নামাজ পড়তে আসেন তখন সবাই খানিকক্ষণ হেসে মজা নেয়। ভাইও হালকা হেসে বসে যান।

নড়বড়ে দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো পরিচিত একটি মুখ। মানুষটিকে এলাকায় সবাই মুরুব্বি হিসেবে সম্মান করে। আমাদের এলাকার সবচেয়ে
বয়স্ক মানুষ সম্ভবত।বয়সের কারণে তিনি পিঠের কাছে হার মেনেছেন অনেক আগে।স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারতেন না। মারা যাচ্ছেন না কেনো এ নিয়ে আলোচনাও হয়েছিলো। তবে সবার জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে তিনি মারা যাচ্ছেন বলে শুনলাম। শরীরে কি যেনো এক মরণব্যাধি রোগ বাসা বেধেঁ ছিলো এতদিন। সেই বাসা পরীক্ষা করে ডাক্তার এ কথা জানালেন। মানুষটির প্রতি আমি প্রথম থেকেই আগ্রহবোধ করতাম কারণটা হয়তো তার চলাফেরার কারণে।
মসজিদে মুরুব্বিদেরকে আমি সবসময় আগে আসতে দেখতাম কিন্তু তিনি আসেন সবার পরে।তাকে কোনোদিন হাসতে দেখেছে এ কথা কেউ বলতে পারবে না।

নামাজ শেষে মুনাজাতের জন্য হাত ধরলাম।এমন সময়ে চিল্লাচিল্লি শুরু হলো। আমি পিছনে তাকিয়ে দেখলাম বিশালদেহী মানুষটির পাশে একটি ছোট ছেলে চোখগুলো বড় বড় করে তাকিয়ে হালকা হাঁসার চেষ্টা করছে। এমন সময় আমি আবিষ্কার করলাম আমাদের এলাকার সবচেয়ে বৃদ্ধ এবং আমার আগ্রহের মানুষটি আস্তে আস্তে হাসছেন। এবার তিনি উচ্চস্বরে হাসতে লাগলেন।

অন্য কোনো সময় হলে হয়তো আমি চিন্তা করতে চেষ্টা করতাম এই ছোট বাচ্চাটির মসজিদে প্রসাবের মাধ্যমে বৃদ্ধটি হাসির কি দেখলো। কিন্তু সবকিছু ভুলে আমি বৃদ্ধটির হাসি উপভোগ করতে লাগলাম। এ হাসি আমি আগে কখনো দেখিনি। এ হাসি সেই সদ্য যুবকের প্রেয়সীর মেসেজ পাওয়ার পরের হাসির মতো ছিলো না, এ হাসি নিজের বিশ্বাস নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত সেই বড় ভাইটির অস্বস্তিজনক হাসির মতো ছিলো না, এ হাসি সেই খানিকক্ষণ মজা নেওয়া জনতার হাসির মতো ছিলো না, এ হাসি সেই ছোট বাচ্চাটির ক্ষমা চাওয়ার হাসির মতো ছিলো না।

এ হাসি ছিলো ধূলোয় জমে যাওয়া এক স্মৃতির হাসি, এ হাসি ছিলো পৃথিবীর সুন্দরতম হাসি, এ হাসি ছিলো অপরাহ্ণের হাসি!

(কাল্পনিক)

No comments

Theme images by fpm. Powered by Blogger.